শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নয়নের নির্দেশিকা: কেন এটি বাস্তবায়ন অযোগ্য


দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরীর সুতিকাগার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। কতটা ভালো গ্র্যাজুয়েট বের হবে সেটি নির্ভর করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের উপর।আর শিক্ষার মান প্রধানত নির্ভর করে ভালো শিক্ষকের ওপর। শিক্ষকরাই একটি জাতির ভিত রচনা করে, জাতির গড়ার কারিগর হিসেবে ভূমিকা রা্খে। এ ধ্রুব সত্যটি যে দেশ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছে, তারাই উন্নতির শিখরে তত দ্রুত পৌছে গেছে। এজন্য সারাবিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় মেধাকে। সর্বোচ্চ মেধাবীরাই এ পেশায় আসে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এদেশেও সর্বোচ্চ মেধাবীরা এ পেশায় থাকতে চায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ই এর একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত। দেশের কৃষিতে উন্নতি চোখে পড়বার মতো। ক্লাসে টপাররা এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে দক্ষ কৃষিবিদ তৈরীর মাধ্যমেই দেশে কৃষির এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। 

অত্যন্ত দুঃখ ও উদ্বিগ্নের সাথে আমরা লক্ষ করছি, একটি বিশেষ মহল উচ্চশিক্ষার যে ক্রমবিকাশ, সেটিকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য চক্রান্তে মেতে উঠেছে। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবী। একটি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা কোন পেশায় যাবে সেটি অনেকটাই নির্ভর করে সেই পেশার পেশাগত সুযোগ সুবিধার উপর। দিনের পর দিন একটি পেশার পেশাগত সুযোগ সুবিধা কমতে থাকলে, সেটি সর্বোচ্চ মেধাবীদের দৃষ্টি আকর্ষনে ব্যর্থ হবে। ২০১৫ সালের বেতন কা্ঠামোতে শিক্ষকদের অবনমন ছিলো এটির প্রথম ধাপ। আর দ্বিতীয় ধাপে এখন এসেছে শিক্ষকদের নিয়োগ ও প্রমোশনের অভিন্ন নির্দেশিকা। এটি উচ্চশিক্ষার উন্নতির জন্য নয়, বরং উচ্চশিক্ষার ধ্বংসের পেরেক হিসেবে আমি অভিহিত করতে চাই। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, বিশেষ করে নিয়োগ ও প্রমোশন সংক্রান্ত বিষয়ে। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির একটি অভিন্ন নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে ইউজিসি থেকে এবং এটিকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এধরনের কোন নির্দেশের সুযোগ ইউজিসির আছে কিনা সেটি যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়ত্বশাসনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।  

একটি বিশ্ববিদ্যলয়ে শুধু শিক্ষকরা থাকেন না। এখানে কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও থাকেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রত্যেকের জন্য নিদিষ্ট নিয়োগ ও পদোন্নতির বিধিমালা রয়েছে। ইউজিসি যে নীতিমালা শিক্ষকদের জন্য করলো, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সাথে এটি  সাংঘর্ষিক হবে কিনা সেটি যেমন একটি বিষয়, তেমনি এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে  শিক্ষকদের মান-মযার্দাকে কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটিও বিবেচ্য। এ থেকে এটি স্পষ্ট যে এটি শুধুমাত্র শিক্ষকদেরকে টার্গেট করে করা হয়েছে। এটি উচ্চশিক্ষাকে কিভাবে সুরক্ষিত করবে তা আমার বোধগম্য নয়। শিক্ষকদের প্রমোশনকে বিলম্বিত করলে উচ্চশিক্ষার কি উপকার হবে তাও যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ।  বরং এটি একটি স্থিতিশীল, শৃঙ্খলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপরিবেশকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সাধারণত ক্লাসের সব থেকে মেধাবীরাই নিয়ােগ পেয়ে থাকে। যেমন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে টপ ৭% থেকে নিয়োগের বিধান আছে। যার ফলে টপাররাই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে এখানে। বারবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি একটি মহলের যে একচোখা মনোভাব এবং এটির প্রতিফলনে যে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও  মযার্দার ক্রমাবনতি, সেটি নিঃসন্দেহে এ পেশায় মেধাবীদের আসার পথকে রুদ্ধ করবে। যার ফলাফল দেশের টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। এ মূহুর্তে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। তারা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এসব দেশে অবস্থান করছেন।  এ অবস্থায় তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যদি ডিমোটিভেটেড হয়ে এ পেশায়্  আর ফিরে না আসে, সেটির দায় কে নিবে।

দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে, উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে গবেষণায় আরও জোর দিতে হবে। কে করবে এ গবেষণা? দেশের মেধাবী সন্তানরা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গবেষণার কেন্দ্র। শিক্ষকরা হচ্ছেন এর নায়ক। তাদেরকে বারবার অনুৎসাহিত করা হলে, সর্বোচ্চ মেধাবীদের এ পেশায় আসার পথ রুদ্ধ হলে, উচ্চশিক্ষাকে এভাবে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা হলে গবেষণা আরও তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। ভূলে যাবেন না, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এমনি এমনি আসে নি। বিগত ৬০ বছরের (১৯৬১ তে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত) কৃষিতে  নিরলস গবেষণার মাধ্যমে দেশ আজ এ অবস্থায় পৌছেছে।  আজ বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষি অভিনন্দিত। অথচ এর কারিগর সেই শিক্ষকদেরকে পদে পদে অপমানিত করা হচ্ছে,  বিভিন্ন বঞ্চনা করা হচ্ছে, ডিমোটিভেটেড করা হচ্ছে। শিক্ষকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অনেক। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি থেকে শুরু করে সরকারি স্কলারশীপ সব জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার।  তারপরও তারা মুখ বুঝে সব সহ্য করেছে জাতির বিবেক হিসেবে। কিন্তু এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

বেশি দূরে যেতে হবে না পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে তাকান। তাদের শিক্ষকদের  সুযোগ সুবিধা, মর্যাদা দেখুন। তাদের গবেষণার বরাদ্দ দেখুন ও ফলাফল দেখুন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বেশি দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই জাগ্রত হোন। দেশের সব টপাররা যাতে গবেষণায় আত্ননিয়োগ করতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পেশাকে আকর্ষনীয় করে তুলুন। আপনারা এমনভাবে আকষর্ণীয় করেছেন একটি বিশেষ প্রফেশনকে, নিজ নিজ প্রফেশন ছেড়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টপাররা সবাই সেটির দিকেই ঝুকঁছে।  একবার ভাবুন,  দেশ সেটি থেকে কি পাবে। সব মেধাবীরা আজ আনপ্রোডাক্টিভ একটি জবের দিকে ধুকছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশাকে, গবেষণাকে এরকম আকর্ষনীয় করে তোলা উচিত ছিলো।দেশের সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য ক্যারকুলেটর নিয়ে হিসেবে বসুন। এই টপার মেধাগুলোকে গবেষণার কাজে লাগাতে পারলে দেশের ভবিষ্যত কোথায় যাবে। ব্রেন ড্রেইন কি পরিমাণ হচ্ছে সেটিকেও বিবেচনায় নিন। কারণ অনুসন্ধান করুন।

এরকম কোন নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরী হলে,পরবর্তীতে আরও নির্দেশনা  আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষায়িত কলেজে পরিণত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসনকে খর্ব করে এ ধরনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের এগিয়ে আসা উচিত।  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন তথা উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ এটিকে প্রত্যাখান করেছে। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বনামধন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এটিতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত কোন অনিয়ম নেই। সর্বোচ্চ মেধাবীরা যাতে এ প্রফেশনে আসতে পারে তার জন্য  নিয়োগ ক্রাইটেরিয়ায় টপ ৭% কে নিয়োগের বিধানে রাখা হয়েছে যেটির মাধ্যমে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে।  পদোন্নতির জন্যও এখানে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এ ধরনের নির্দেশিকা বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নীতিমালার থেকেও লোয়ার স্টান্ডার্ড। পাশাপাশি যে প্রক্রিয়ায় এটি প্রণীত হয়েছে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের  স্বায়ত্বশাসনে সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি, এটি বাস্তবায়িত হলে মেধাবীরা এ প্রফেশনে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, শিক্ষা ও গবেষণায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের কৃষিক্ষেত্রে অব্যাহত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে, মেধাবীদের এ পেশার মাধ্যমে গবেষণায় আরো বেশি আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে আরো ত্বরান্বিত করার স্বার্থে এ ধরণের কোন নীতিমালা বা নিদের্শিকা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ  নেই।

মোঃ নূরন্নবী ইসলাম সাগর, সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box