নির্বাচনই কি সব সমস্যার সমাধান?

বাংলাদেশ। আমার জন্মভুমি। আমার ভালবাসা, আবেগ। বিদেশে এসে অনেকবার যেটা শুনতে হয়েছে, তা হলো 'ওখানেই থেকে যাও'। কিন্তু আমার একটিবারের জন্যও তা মনে হয় নি। আমি উদগ্রীব হয়ে আছি দেশে ফেরার জন্য। কিছুদিন আগে একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়েছে। সরকার পতন হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছে। নানান চরাই উতরাই এর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ। 

স্বাধীনতা পূর্ব এই দেশ স্বাসিত ও শোষিত হয়েছে পাকিস্তানের দ্বারা। স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিবিদদের দ্বারা। তাঁদের সাহায্যকারী হয়েছে সরকারি আমলা কর্মকর্তারা। দেশটাকে শুষে তারা একেক জন হয়েছেন কোটিপতি। রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক পেশা এই দেশে। সব রাজনীতিবিদ যদিও একরকম নন, তবে যারা এই দেশ শাসনে এসেছেন বিভিন্ন সময়, প্রত্যেকেই কম বেশি এই দেশকে শুষে নিয়েছেন। 

একেকজন একেক রকম চেতনা বেঁচেছেন। কেউ মুক্তিযুদ্ধ, কেউ জাতীয়তাবাদ, কেউ ধর্ম এসব। একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে ভোট দেয়া ছাড়াই। একদলকে দেশের ছাত্র জনতা অতিষ্ঠ হয়ে বিদায় করেছে। অনেক দল গোঁফে তেল দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা ইতোমধ্যেই আগের কিটের স্থানে নতুন কিটের আগমন ঘটেছে। চারদিকে যে হুঙ্কার, তর্জন গর্জন চলছে, তা দিয়ে সামনের দিনগুলো অনুমান করা কঠিন নয়। 

এই দেশটার আসলে ভবিষ্যৎ কি? কোটি কোটি মানুষ বেকার।কোটি কোটি মানুষ অশিক্ষিত। শিক্ষিতদের একটা বড় অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। ড ইউনূস আসার পর যেটুকু আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল, তাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে, মূল্যস্ফীতি কমে  নি, সাধারন মানুষের নাভিশ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধ তলানিতে গিয়ে থেকেছে, ট্রাফিক থেকে শুরু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোনখানেই শৃঙ্খলা নেই। আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে পারে নি। খুনসহ সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? ৩ মাস পার হয়েছে। এখন তো আমরা আরও ভাল কিছু আশা করেছিলাম। 

 যারা সম্ভাব্য ক্ষমতায় আসতে পারেন , তারা কি আগে দেশ শাসন করে নি? কেমন ছিল সেই শাসন? সেই সময় কি দুর্নীতি হয় নি? তাহলে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা কিভাবে তাঁদের উপর ভরসা করবো? ভরসা করার মত কাজ তাঁদের করতে হবে। তারা যে আগের মত করবেন না, অন্য বাংলাদেশ আমাদের উপহার দিবেন, সেটি বিশ্বাস করবার মতন কাজও তো করতে হবে। এখনি যদি দলের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন, সেটি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ের। নতুন বাংলাদেশ রাজনীতিবিদদের  হাত ধরেই আসবে। আমরা অপেক্ষায় রাজনীতির গুনগত পরিবর্তনের। 

নির্বাচন দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হবে। কখনই না। এই দেশের সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। নির্বাচনের আগে দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে, রাজনীতিবিদের আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খল করা, জনসাধারনকে একটা উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, আইন মানতে বাধ্য করা, আইন সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ করা, এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে। এই সরকার দিয়ে সেটি সম্ভব নয়। আবার নির্বাচনের মাধ্যমে কোন একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে আসলে, আবার সেই পুরনো বৃত্তের কক্ষপথেই আমাদের ঠিকানা। এমতাবস্থায় করনীয় কি?

এই জটিল সমস্যার সমাধান একটাই। তা হল জাতীয় সরকার গঠন করা। জাতীয় সরকারে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জিনিয়াসরা থাকবেন। ছোট বড় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।  দেশ বরেণ্য অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবিরাও থাকবেন এই সরকারে। তাঁদের একমাত্র কাজ হবে দেশটাকে সঠিক পথে তুলে দেয়া। সংবিধান প্রণয়ন থেকে শুরু করে পলিসি তৈরি, আইন মেরামত সহ দেশ ও দেশের জনগণকে সঠিক রাস্তায় তুলে দেয়া। আবহমান সংস্কৃতি পরিবর্তন করা। ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত, আইনের শাসন সম্বলিত জবাবদিহিতার এক নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা।  এটি হলেই আমি মনে করি এই বিপ্লব সার্থক। কিন্তু শুধু যদি ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়, তাহলে সেটি হবে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। 


মন্তব্যসমূহ