ভারতের বাংলাদেশ রাজনীতি, কূটনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই

 

হঠাৎ ভারতবর্ষের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠলো বাংলাদেশকে নিয়ে। অভিযোগ সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু নির্যাতন। সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ প্রস্তুত করছে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো। ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে ক্ষমতার মসনদকে পোক্ত করাই আসল উদ্দেশ্য। এই বৈরি সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ভারত না করলে, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মত বাংলাদেশকেও হারাতে হবে বন্ধু রাষ্ট্রের তালিকা থেকে। কোন প্রতিবেশির সঙ্গেই তাহলে আর ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে না, যেটি কোনভাবেই ভারতের জন্য শুভ নয়।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। দেশ যদি কাউকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে ও যথাযথ অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়, সেটিকে ধর্মীয় অবয়ব দিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ কেবল এই ভারতের পক্ষেই সম্ভব। এটি নিয়ে অযাচিত ও মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপস্বরূপ। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত যতখানি সরব, তার কিঞ্চিতও নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে হলে এত এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মৃত্যুর গ্লানি ভারতকে বয়ে বেড়াতে হতো না। বাংলাদেশ একটি বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলে উনি ভারতে আশ্রয় নেন। বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশিল করবার পরিকল্পনা উনি করেই যাচ্ছেন। ভারতও একই পথে হাটছে বলে আমাদের ধারণা।

প্রফেসর ইউনূস সরকার গঠনের পর থেকেই উনি কোন মহলকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন নি। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি ট্র্যাম্প কার্ড। এটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই। উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কতটা অনিরাপদ। এই সরকারকে অসফল দেখানো। এটির অনেকখানি যে দিল্লি থেকেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেটি এখন অনেকটা পরিস্কার। যারা বাংলাদেশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা ভারতের সংবাদমাধ্যমের নির্লজ্জ মিথ্যাচার খুব সহজেই ধরতে পারবেন।  হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। কয়েশ ছাত্র হত্যা হয়েছে, গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুদ্ধ জনতা পুলিশ সহ যারা সেই সরকারের দোসর ছিল, ছাত্র হত্যায় মদদ দিয়েছে, তাঁদের উপর চড়াও হয়। অনেকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, অনেককে হত্যা করে। দেশে তখন কোন ল অ্যান্ড অর্ডার ছিল না। তিন দিন পর প্রফেসর ইউনূসের সরকার গঠিত হয়। অনেক পুলিশ ছাত্র হত্যায় জড়িত থাকায় কাজে আর যোগ দেন নি। এরকম ভঙ্গুর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উনি আপ্রান চেষ্টা করতে থাকেন সবাইকে শান্ত করবার। হিন্দুদের বিষয়ে দেশবাসী আগেই অবগত ছিল। তাই তাঁদের মন্দির পাহারায় ছাত্ররা নিয়োজিত হলেন। পতিত আওয়ামি লিগের অনেকেই চেষ্টা করতে থাকল এসব ভাংচুরে, যাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ট্যাগ দেয়া যায়। কিন্তু ইউনূস সরকার সে আগুনে পানি ঢেলে দিল। এরপর শুরু হল ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচার। তারা পুড়ে যাওয়া মাশরাফীর বাড়িকে লিটন দাশের বাড়ি বলে সংবাদ প্রচার করতে লাগলো। আইন শৃঙ্খলার ভঙ্গুর অবস্থা মুসলিম, হিন্দু সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা পতিত সৈরাচারের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া এখান থেকে  ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দিতে থাকলেন।

সর্বশেষ তারা উত্তাল হয়েছেন ইস্কনের একজন ধর্মগুরুকে গ্রেফতার করা নিয়ে। যাকে কিনা ইস্কন বাংলাদেশ বহিস্কার করেছে  গুরুতর অভিযোগে। তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে ইস্কন ও কতিপয় উগ্রবাদী হিন্দু একজন মুসলিম আইনজীবীকে আদালত প্রাঙ্গনে কুপিয়ে হত্যা করে। এরকম একটি পরিস্থিতি আপনি ভারতে চিন্তা করতে পারেন? অথচ বাংলাদেশ এটির প্রতিক্রিয়ায় কোন হিন্দুকে মরতে হয় নি। বাংলাদেশি মুসলিম ধর্মগুরুরা সবাইকে শান্ত থাকবার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের তৎপরতায় পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রনে। ভারতীয় মিডিয়া এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুলকালাম শুরু করে দিল। হত্যা হল মুসলিম, ভারতীয় মিডিয়া তাকে সেই ইস্কন ধর্মগুরুর আইনজীবী হিসেবে পরিচয় করালেন। উনি ছিলেন একজন রাস্ত্রপক্ষের আইনজীবী। মিথ্যাচারের সব লেভেল পার করল ভারতীয় মিডিয়া।

তারা যে ধর্মীয় ইস্যুতে কতটা দাঙ্গাবাজ, তার প্রমাণ রাখলেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা করে, পতাকা পুড়িয়ে। তাঁদের এই উগ্রতায় ভারতের সংখ্যালঘুরা যে কতটা নিরাপদ, সেটি অনুধাবন করা কঠিন নয়। ভারতে সরকারে এখন ধর্মীয় মৌলবাদী একটি দল। যারা ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে কত সংখ্যালঘু যে মারা গেছেন, সেটির হিসেব নেই। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাই তাঁদের রাজনীতি। গুজরাট রায়ট কিংবা বাবরি মসজিদ এর জলন্ত উদাহরণ। এখন তো প্রায় সব মসজিদের নিচেই মন্দির খুঁজে পাচ্ছেন তারা। অথচ এই ভারত সরকার বিগত সরকারের সময় কোন হিন্দু নির্যাতন নিয়ে কোন অভিযোগ তোলেন নি। ছাত্রলিগের সন্ত্রাসীরা যখন বিশ্বজিতকে শিবির ভেবে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করল, তখন তাদের বিবেক জেগে উঠে নি।    

 

বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রিতির দেশ। এদেশে কখনই রাষ্ট্রীয় মদদে সংখ্যালঘু নিধন হয় নি ভারতের মত। তবে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিভিন্ন সময় হয়েছে, যার অনেকগুলোই ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক। বরং বিগত সরকারের সময় মুসলিমরাই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, অনেককেই জামাত শিবির ট্যাগ দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। আবরার ফাহাদ কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেক মুসলিম দাড়ি পর্যন্ত রাখতে পারে নি। অনেকেই অহেতুক শুধু সন্দেহের কারণে জেল জুলুম ভোগ করেছেন। গুম, খুনের স্বীকার হয়েছেন। এই ছাত্র আন্দলনে ১০০০ এর বেশি ছাত্র জনতা মারা গেছে, এখানে তো হিন্দুও ছিল, মুসলিমও ছিল। রিয়া গোপ নামে ৬ বছরের একটি হিন্দু শিশু বাড়ির ছাঁদে খেলতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। তখন ভারতের এত প্রতিক্রিয়া কই ছিল? তখন তো হাসিনা সরকারকে হুমকি দেন নি। বরং সহযোগিতা করতো। এই গণহত্যার দায় তারাও এড়াতে পারে কি? আমাদের প্রত্যাশা একজন মানুষসে সংখ্যালঘু হোক কিংবা সংখ্যাগুরু, কেউই কারও দ্বারা নির্যাতিত না হোক, এরকম মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমরা।  

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের যে অনেক পরিকল্পনা ছিল, সেগুলো হাসিনা সরকার চলে যাওয়াতে বাস্তবায়ন করা আর সম্ভব নয়। পাশপাশি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিলে, ভারতে নিজেদের রাজনীতিও চাঙ্গা করা উদ্দেশ্য। মসজিদের নিচে মন্দির খুঁজে পাওয়ার সাথে এই ইস্যুটাও যুক্ত করা গেলে ফায়দা অনেক বেশি। এইসব হীন উদ্দেশে ভারত বাংলাদেশের পিছনে লেগেছে। সব প্রতিবেশীকে খেপিয়ে নিজেদের কি করে তুলছেন? আপনাদের পররাষ্ট্রনীতি যদি বাংলাদেশ ভিত্তিক না হয়ে, হাসিনা ভিত্তিক হয়, তবে সেটি পরিবর্তন করুন। বাংলাদেশ আপনাদের নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রস্তুত।  বাংলাদেশ আপনাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে না, আপনারাও বন্ধ করুন। আমাদেরকে সেটি করতে বাধ্য করবেন না। আমাদের আবহমানকাল ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি নষ্ট করবেন না। সেটিতে সফল হওয়া সহজ নয়। গমানুষের  রাজনীতি করুন। এই দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। দুই দেশের কূটনৈতিক আলোচনার পর সম্পর্কে উন্নতি হবে বলে আমাদের ধারণা।   

 

মোঃ নূরন্নবী ইসলাম

পিএইচডি গবেষক, জাপান ও সহকারী প্রফেসর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

sagor.as@bau.edu.bd

মন্তব্যসমূহ