দুর্নীতি: কবে মিলবে মুক্তি?


একের পর এক দুর্নীতির খবর জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। এ যেন দুর্নীতির জোয়ার চলছে। পাল্লা দিয়ে চলছে। কোন প্রতিষ্ঠান কার থেকে বেশী দুর্নীতি করতে পারে তার প্রতিযোগীতা। আর আমরা সাধারণ মানুষ এর দর্শক।শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কিছুদিন মিডিয়ার কল্যাণে সরব সবাই। কিছুদিন পর আগেরটির আলোচনা চাপা পড়ে নতুন কোন সংবাদে। এভাবেই এগিয়ে চলছে স্বদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি সব কটি সরকারের আমলেই ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে এটি বেড়েই চলেছে। এবারের সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল একটু অন্যরকম। কিন্তু যে দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলা যে সহজ কাজ নয়, তা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে চোখে পড়ছে। ব্যক্তি ছেড়ে দুর্নীতি পেয়েছে প্রাতিষ্ঠিানিক রূপ। যে যত বেশী শিক্ষিত, যত বেশী ক্ষমতা প্রর্দশন করতে পারে, তার  দুর্নীতির ব্যাপকতা তত বেশী। কেউ ছাত্র হয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ২০০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, আর অন্যদিকে গরিব কৃষক দুবেলা ভাতের চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারে না। যারা যতবড়  দুর্নীতিবাজ, তারা তত বড় চেতনাবাজও বটে। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর নাম, আর কাজ করে নিকৃষ্টতম। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতির ঘটনা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ব্যাপকতর হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশকিছু সদস্য, প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে শুরু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাও পিছিয়ে নেই। অতিসাম্প্রতিক সময়ে পাপিয়া, সাহেদ, সম্রাট, জিকে শামীশ, ওসি প্রদীপ সহ অনেকেই রাজনৈতিক পরিচয় বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে দুর্নীতি করেছে। হাজার হাজার দুর্নীতির মামলা আদালতে ঝুলছে। অধিকাংশই দুদকের করা। 

দেশের চলমান মেগাপ্রজেক্ট গুলোর বেশিরভাগেরই কেনাকাটায় অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপিপি বাস্তবায়নেও দুর্নীতি হয়েছে এবং হচ্ছে।  অতি সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্পের কেনাকাটায়ও প্রত্যেকটি জিনিসের অস্বাভাবিক দাম চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। কিছু কিছু জিনিসের দাম তার বর্তমান সর্বোচ্চ মূল্যের থেকেও ১০ গুন বেশী দাম ধরা হয়েছে। অতিথির বসার জন্য একটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ছয় লাখ টাকা যেটির বর্তমান সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ৫০ হাজার টাকা। দুধে কী পরিমাণ পানি আছে, তা মাপার একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা যা ৬০ টাকায়ও পাওয়া যায়। একটি বর্জ্য রাখার পাত্রের দাম আড়াই লাখ টাকা। এগুলো তো নমুনা। প্রথম আলোর করা পুরো প্রতিবেদনটি পড়লে আপনি স্বাভাবিক থাকবেন না্, শুধু মনে হতে থাকবে এরকম একটি খসড়া কীভাবে অনুমোদন পায়?  সরকারি পাটকল, চিনিকল, বিমান, রেলওয়ে, বাস, সহ প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র দুর্নীতির কারণে। কেন হচ্ছে এসব? কেন আমাদের মনে হচ্ছে দেশে দুর্নীতির প্রতিযোগীতা চলছে? এর থেকে উত্তরণ কোথায়?  কোথায় যাচ্ছে দেশ? এগুলো থেকেই বোঝা যায় এদেশের জবাবদিহিতা কতটুকুন আর অবশিষ্ট আছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদের কাছে জবাবদিহি করবে তারাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তানাহলে রিজেন্টের মতো হাসপাতাল কীভাবে করোনা চিকিৎসার সরকারী তালিকাভূক্ত হয়? অবশ্যই অনেকগুলো স্তর পার হয়েই বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের কেনাকাটার খসড়া পাশ হয় বা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। একটা সিস্টেমের প্রত্যেকটা স্তরেই যখন করাপ্ট লোকজন থাকে তখনই কেবল এটি সম্ভব। এদের মধ্যে যারা সৎ, হয় তাদের আপোষ করে চলতে হয়, না হলে ওএসডি হয়ে বসে থাকতে হয়। সৎলোকেরা ঐক্যবদ্ধ না, বিক্ষিপ্ত। এদের কোন সিন্ডিকেট নেই যেটি দুর্নীতিবাজদের আছে।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত প্রত্যেকটি দেশেই দুর্নীতির গ্রাফ উদ্ধমুখী। কিছুদিন আগেই লেবানন সরকার দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। সেখানকার সরকারপ্রধান এটি স্বিকার করে নিয়েছে যে সরকারের প্রত্যেকটা স্তরে যে পরিমান দুর্নীতি, সেটি দমন করা উনার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমাদের দেশও একসময় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। বর্তমানে ও উপরের সারিতেই অবস্থান করছি। এভাবে চলতে থাকলে আবার সেই মুকুট মাথায় এসে পড়বে। সময়ের একফোঁড়, অসময়ের দশফোঁড়। এখনই এবং এখনই এদের লাগাম টানতে হবে। দুএকজনকে ধরে শাস্তির আওতায় এনে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। দুর্নীতিবাজরা যুদ্ধাপরাধীদের মতোই অপরাধী। তাদের জন্য আলাদা ট্রাইবুন্যাল করে দ্রুত বিচার আইনে মামলাগুলো নিস্পত্তি করা উচিত। এর লাগাম ধরতে না পারলে উন্নয়ন করেও কোন লাভ হবে না। যদি উন্নয়ন ও দুর্নীতি সমানুপাতিক হয়, সেক্ষেত্রে সেই উন্নয়ন করে ক্রেডিট পাওয়া যায় না।

দেশের বর্তমান বাস্তবতায় শুধু একটাই এজেন্ডা বাস্তবায়নের শপথ নেয়া উচিত সরকারের। আর সেটি হল দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশ সত্যিই দুর্নীতিমুক্ত। আমরা মনে করি শুধুমাত্র দুর্নীতি ঠেকাতে পারলেই সোনার বাংলা সম্ভব। অন্যথায় অসম্ভব। কবে সেদিন আসবে যেদিন মুদি দোকান থেকে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় সব অফিস, সব বাহিনী, সব প্রকল্প, সব প্রতিষ্ঠান, সব মন্ত্রণালয় থাকবে দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতি নামে কোন জিনিসই থাকবে না। সেটি কিন্তু আপনিও উপহার দিতে পারেন। শুধুমাত্র সেদিনই এদেশ হবে সত্যিকারের ’সোনার বাংলা’। সেই বাংলাদেশের প্রত্যাশায়।

মন্তব্যসমূহ