লাম্পি স্কিন ডিজিজ: যা জানা প্রয়োজন

 


বর্তমান সময়ে গবাদিপশুর বিশেষ করে গরু, মহিষের একটি বহুল আলোচিত সমস্যা হচ্ছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ ( Lumpy Skin Disease বা LSD)। এটি একটি মারাত্বক সংক্রামক রোগ। বাংলাদেশে এটি খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে যেটি যথেষ্ট উদ্বেগের। এ রোগটির উৎপত্তি, বিস্তার, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সম্ভাব্য প্রতিরোধ নিয়ে আজকের এই লেখা্। 

ভাইরাসের প্রকৃতি

লাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস (Lumpy Skin Disease Virus) বা  LSDV নামক ভা্ইরাসের সংক্রমণের কারণে এটি হয়। এ ভাইরাসটি Poxviridae গোত্রের, Capripoxvirus গণ (Genus) এর  অন্তর্ভুক্ত। Sheeppox virus ও  Goatpox Virus দুটির প্রজাতিও একই (Capripoxvirus) গণভূক্ত। এটি একটি ডাবল স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস।

এ ভাইরাসটি পোষক নির্দিষ্ট। এটি শুধুমা্‌ত্র গবাদিপশুকে প্রধানত গরু ও মহিষকে আক্রমণ করে। এর দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আক্রান্ত পশু থেকেও এটি মানুষে ছড়ায় না। হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান, জার্সি, সংকর জাতের গরু এ রোগের প্রতি বেশী সংবেদনশীল। 

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

লাম্পি স্কিন ডিজিজের লক্ষণসমূহ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২৯ সালে জাম্বিয়ায়। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে এ রোগটি যে সংক্রামক সেটি চিহ্নিত হয়। ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮ মিলিয়ন গরু এটিতে আক্রান্ত হয়। লাম্পি স্কিন ডিজিজ হিসেবে প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৫৭ সালে কেনিয়ায়। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এটি আফ্রিকা মহাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত গরুর মাধ্যমে এটি মিশর এবং আরো পরে ইজরাইল হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালের পর এটি গ্রীস হয়ে ইউরোপসহ রাশিয়া, কাজাখস্থান এ ঢুকে পড়ে। বর্তমানে এটি এশিয়াসহ সারাবিশ্বে গবাদি পশু বিশেষ করে গরু, মহিষের একটি মারাত্বক রোগ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।

কীভাবে ছড়ায়

লাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি অতিসংক্রামক রোগের মধ্যে পড়ে। এটি  আক্রান্ত পশু থেকে ছড়ায়। এটা ছড়ানোর প্রধানতম কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা আর্থ্রোপোড ভেক্টর  যেমন মশা (কিউলেক্স, এডিস), বাইটিং ফ্লাইস,  বিভিন্ন প্রজাতির আটালি বা টিককে দায়ী করেন। এছাড়াও আক্রান্ত প্রাণির সিমেন, স্যালাইভা, স্যালাইভা মিশ্রিত পানি, খাবার, ব্যবহৃত সিরিন্জের সূচ, রক্ত, নডিউলের ভিতরের জলীয় অংশ ইত্যাদির মাধ্যেমে ছড়াতে পারে। যদিও গবাদিপশু কীভাবে আক্রান্ত হয় সে সম্পর্কে আরও গবেষণা দরকার। এটির সঠিক কারণ এখনও অজানা।

লক্ষনসমূহ

এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গবাদিপশুর চামড়ায় বিশেষ ধরনের গুটি বা নডিউল (Lymph Node) দেখা যায়। জ্বর ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপর হতে পারে। পাশাপাশি খাবারে অনীহা দেখা দেয় ও শারিরিকভাবে দূর্বল হতে পারে। অতিরিক্ত লালাক্ষরণ হতে পারে, নাক ও চোখ দিয়েও ডিসচার্জ আসতে পারে। ২-৫ সে.মি. বা এর থেকে বড় ডায়ামিটারের নডিউল পুরো শরীরে বিশেষ করে মাথা, ঘাড়, পা, গলকম্বল, মাজল, ওলানের  চারপাশ এ দেখা দিতে পারে। নডিউলের ভিতরে মায়োসিস হতে পারে। নডিউল ফেটে চামড়ায় ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পানিও জমতে পারে। দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে এবং পরবর্তীতে কয়েক মাস পর্যন্ত হিট এ নাও আসতে পারে। ষাড় এর ক্ষেত্রে সাময়িক বা পুরোপুরি বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। সেকেন্ডারী ইনফেকশন  থেকে নিউমোনিয়া, ম্যাস্ট্যাইটিসও হতে পারে।

পরীক্ষার জন্য  ভাইরাস পৃথকীকরন 

আক্রান্ত গবাদিপশুর চামড়ার নডিউল এ ভাইরাসটি থাকে। এখান থেকে আক্রান্ত হওয়ার পর ৩৫ দিন বা এরও বেশী দিন পর্যন্ত ভাইরাসটি আলাদা করা যাবে। পাশাপাশি এর রক্ত, লালা, চোখ ও নাক থেকে নিগত পদার্থ, সিমেন থেকেও  ভাইরাসটি পৃথক করা যায়। রক্তে ৭-২১ দিন ও সিমেনে ৪২ দিন পর্যন্ত ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পরীক্ষার জন্য ভাইরাসটির স্যাম্পল সংগ্রহ করে পিসিআর টেস্ট এর মাধ্যমে কনর্ফাম হওয়া যায়।

টেস্ট ছাড়া অনেক সময় মৃদু সংক্রমণ হলে এটি ডায়াগনোসিস এ ভূল হতে পারে। কেননা বোভাইন হার্পেস ভাইরাস ২ (যেটিকে সিউডো লাম্পি স্কিন ডিজিজ বলে), ডারমাটোফিলোসিস, রিনডারপেস্ট, ইনসেক্ট বাইট, প্যারাপক্স ভাইরাস, কাইপক্স  ভাইরাস, সহ বেশ কিছু রোগের সাথে বাহ্যিক লক্ষণগত মিল থাকায় টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়াই ভালো। তবে মারাত্বক সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাহ্যিক লক্ষণসমূহ প্রকট থাকায় এটি সহজেই বোঝা যায়।


বাংলাদেশে  লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস 

বিগত দুই বছর যাবত বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এ বছর দেশের অনেক জেলায় এ রোগ সনাক্ত হয়েছে। ২০১৯ এর ডিএলএস প্রদত্ত তথ্যানুসারে সারাদেশে ৫,৫৩,৫২৮ টি লাম্পি স্কিন ডিজিজ আক্রান্ত গরু পাওয়া গেছে। ২০২০ এ সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে বেশী আক্রান্ত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এটির মরবিডিটি ১০-২০% ও মরটালিটি ১-৫% এ এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এটিও বাড়তে পারে।আফ্রিকার অনেক দেশে মরটালিটি রেট (১০-৪০% পর্যন্ত) অনেক বেশী দেখা গেছে।

লাম্পি স্কিন ডিজিজ দেশের প্রান্তিক খামারীদের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। চামড়া শিল্পেও এর প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত ও গবাদিপশুর মৃত্যু, দেশে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে একটি একটি স্থবিরতা তৈরী করবে। তাই খামারীদের মাঝে এ রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরাসরি কাজ করে এ রকম কোন ঔষধ এখন পর্যন্ত নেই। তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। ভ্যাক্সিনেশন এখন পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান উপায়। পাশাপাশি নিম্নোক্ত কৌশলগত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।
  • বহিঃপরজীবি নিয়ন্ত্রণই এখন পযর্ন্ত রোগটি প্রতিরোধের কার্যকরী উপায়। বহিঃপরজীবি সংক্রমণ প্রতিরোধে খামার সবর্দা পরিস্কার রাখতে হবে। খাবারের পাত্র, পানির পাত্র, খাবারের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করে রাখতে হবে। নিয়মিত জীবাণুনাশক ছিটিয়ে খামারকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। খামারের আশেপাশে জঙ্গল থাকলে কেটে পরিস্কার করতে হবে। এগুলো মশা মাছির উপদ্রব কমাতে সহায়ক হবে। গবাদিপশুকে যেকোনভাবেই মশা, আটালি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। 
  • নতুন কোন গবাদিপশু হাট থেকে কিনে আনলে, সেটিকে ১৪-২১ দিন আলাদা করে রাখুন। পাশাপাশি তার প্রসাব- পায়খানা, খাদ্যগ্রহণ, তার বিহেবিয়ার পর্যবেক্ষণ করুন। কোন রোগলক্ষণ প্রকাশ না পেলে, সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হলে তাকে খামারের অন্যান্য গবাদিপশুর সাথে রাখুন।
  • খামারের প্রবেশদ্বারে সম্ভব হলে ফুটবাথ রাখুন। নিয়মিত ফুটবাথের পানি পরিবর্তন করুন। খামারে যারা কাজ করবে, তাদের জন্য আলাদা পোষাক বা অন্তত পক্ষে একটি করে এপ্রন আর বুট জুতো দিন। যেগুলো শুধু খামারে কাজ করার সময় ব্যবহার করবে। খামারে যারা কাজ করে, তাদের মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। বাহির থেকে এসে খামারে ঢুকার পূর্বে নিজে হাত পা ভালভাবে ধুয়ে নিন। বায়োসিকিউরিটির ব্যাপারে সচেতন হোন। শুধু মুরগীর জন্য নয়, গবাদিপশুর জন্যও বায়োসিকিউরিটি সমান গুরুত্বর্পূণ।
  • কোন এলাকায় লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাস সংক্রমিত গবাদিপশু পাওয়া গেলে, আশেপাশের প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা সংক্রমণ আশংকার আওতায় চলে আসে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এটি। সুনির্দিষ্ট কোন কারণ বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে পান নি। আক্রান্ত এলাকার কোন গবাদিপশু (সুস্থ ও অসুস্থ উভয়) অন্য কোন এলাকায় নেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। আক্রান্ত এলাকায় গবাদিপশুর হাট,  ক্রয়-বিক্রয় সব বন্ধ রাখতে হবে। 
  • গবাদিপশুর অন্য রোগের চিকিৎসায় সব সময় নতুন সিরিন্জ- সূচ ব্যবহার করতে বলুন। ব্যবহৃত সিরিন্জ- সূচ এর মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। যদিও প্রাণিচিকিৎসকের মাধ্যমে এটি ছড়ায় কিনা সেটি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণালদ্ধ তথ্য নেই, তারপরও প্রাণিচিকিৎসকদের সতর্কতার সহিত গবাদিপশুর চিকিৎসা করা উচিত। বিশেষ করে চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহরের ক্ষেত্রে সতর্ক  হতে হবে। হাতে গ্লোভস ব্যবহার করা ভালো।
  •  কোন প্রাণির মধ্যে কোন লক্ষণ প্রকাশ পেলে সাথে সাথেই তাকে আলাদা করে দিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শমত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এটি ডায়াগনোসিস করা যাবে, ততই প্রাণির সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। সেকেন্ডারী ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্য ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক  দেয়া যেতে পারে। 

ভ্যাক্সিনেশন ও লাম্পি স্কিন ডিজিজ 

লাম্পি স্কিন ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাক্সিনেশনের কোন বিকল্প নেই। Sheep and Goat Pox Vaccine ( SGPV) কে  LSDV নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী বলে জানা গেছে। কেনিয়ায় এটি ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশে শুধু  Sheep Pox Vaccine কে ব্যবহার করা হয়। আবার কোথাও কোথাও  Goat Pox Vaccine কে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে Goat Pox Vaccine কে জরুরি ভিত্তিতে এটি নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। ভাইরাসটির লোকাল স্ট্রেইন আইসোলেট করে এ ভ্যাক্সিনের কার্যকারীতা প্রমাণ করার জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছি। একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিনই কেবল এটি নিয়ন্ত্রণে মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর লাম্পি স্কিন ডিজিজ নিয়ন্ত্রনে কাজ করছে। এ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। প্রাণিসম্পদের  বিকাশে এটি অন্তরায়। রোগটির সঙ্গে ভবিষ্যতে প্রাণি ও প্রাণিজ পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়া জড়িত। দ্রুত নিয়ন্ত্রেনের সব রকম পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করবে এমনটাই প্রত্যাশা।


নূরন্নবী সাগর
লেকচারার, বাকৃবি।


মন্তব্যসমূহ