বাংলাদেশে এখন বর্ষাকাল। গবাদিপশু কৃষির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর যেটি দেশের প্রাণিজ আমিষের মূল যোগানদাতা। বর্ষাকালের এই সময়ে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া, প্যারাসাইট সংক্রমণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায় যেটি প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এই সময়টাতে প্রাণিস্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রাণির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংক্রমণের মাত্রা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। বর্ষাকালে সংক্রমণের মাত্রা কিভাবে কমিয়ে আনা যাবে ও নিরাপদ প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য কোন কোন বিষয়ের উপর দৃষ্টি দিতে হবে সেদিকে আলোপাত করাই আজকের লেখার লক্ষ্য। প্রথমেই দৃষ্টি দেয়া যাক বর্ষাকালে মূলত কি কি সমস্যা দেখা যায় গবাদিপশু পালনে।
আদ্র ও স্যাতস্যাতে বাসস্থান
বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশী থাকে। এসময় গবাদিপশুর বাসস্থানের মেঝে সবসময় ভেজা থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় ছাদের ছিদ্র বা ফুটো থেকেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। কাঁচা মেঝেতে এ সমস্যাটি বর্ষাকালে প্রকট হয়ে উঠে। গবাদিপশুর অনেক রোগ এ সমস্যাটির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ রকম জায়গায় মশা-মাছি ও অন্যান্য প্যারাসাইটেরও আধিক্য দেখা যায়। পাশাপাশি গবাদিপশুর বসবাসের জন্য এ ধরণের মেঝে খুবই অসুবিধাজনক যেটি প্রাণির উৎপাদনেও প্রভাব ফেলে। শুষ্ক ও পরিচ্ছন্ন মেঝে গবাদিপশুর জন্য আরামদায়ক যেটি বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের মাত্রা যেমন কমায়, পাশাপাশি স্বাভাবিক উৎপাদনও নিশ্চিত করে।
পরজীবি সংক্রমণ
আন্তঃপরজীবি ও বহিঃপরজীবির সংক্রমণের হার বছরের অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বর্ষাকালে বেশী দেখা যায়। গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি এ সমস্ত পরজীবি নিয়ন্ত্রণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। পরজীবি প্রাণির উৎপাদনে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবেও কাজ করে। আটালি, উকুন, মশা-মাছি গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ। বোভাইন ব্যাবেসিওসিস, ইস্ট কোস্ট ডিজিজ, আটালি বা টিকের মাধ্যমে ছড়ায়। আন্তঃপরজীবি (কৃমি) প্রাণির উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বর্ষাকালে এটির সংক্রমণও বেড়ে যায়।
বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ
আমি আগেই বলেছি গবাদিপশু রোগ সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুকিঁতে থাকে এ সময়টাতে। কারণ প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর আধিক্য দেখা যায় এ সময়। প্রতিবছর বাংলাদেশে ক্ষুরারোগ বর্ষাকালেই বেশী দেখা যায়। বাদলা রোগ বর্ষাকালের রোগ বলে পরিচিত। তড়কা, গলাফুলা রোগের আধিক্য এ সময়ে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। পাশাপাশি বিভিন্ন পরজীবিজনিত রোগ বিশেষ করে কৃমি, কক্সিডিওসিস, বিভিন্ন মেটাবলিক রোগ যেমন ব্লোট, ডায়রিয়া, গ্রাস টিটানি, টিমপ্যানাইটিস ও বিভিন্ন প্ল্যান্ট পয়জোনিং দেখা যায়। দুগ্ধবতী গাভীর ওলান প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে লাম্পি স্কিন ডিজিজের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।
খাদ্য সমস্যা
বর্ষাকালে গবাদিপশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনায়ও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ সময় প্রচুর পরিমান সবুজ ঘাস পাওয়া যায়। ঘাসের বৃদ্ধি অনেক বেশী থাকায় পরিণত হওয়ার আগেই অনেক সময় ঘাস কাটা হয়। অপরিণত এ ঘাস বেশী পরিমাণে খেলে গবাদি পশুর পেটে গ্যাস বা ব্লোট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। মাঠের সংগ্রহকৃত ঘাসের মাধ্যমে কৃমি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দানাদার খাদ্য সংরক্ষণে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। দীর্ঘদিন সংরক্ষণে আর্দ্রতার কারণে দানাদার খাদ্যে ফাঙ্গাস বিশেষ করে মোল্ড গ্রো করতে পারে যেটি গবাদিপশুর ডায়রিয়া সহ বিভিন্ন মেটাবলিক রোগের কারণ।
সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ যত্নবান হলেই বর্ষাকালেও গবাদিপশুকে সুস্থ রাখা ও উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব। গবাদিপশুর ব্যবস্থাপনায় নিম্নোক্ত কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানো অনেকাংশেই সম্ভব।
১. গবাদিপশুর বাসস্থান বিশেষ করে মেঝে সবসময় পরিস্কার ও শুষ্ক রাখা অত্যাবশ্যক। বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই প্রয়োজন হলে ছাদ মেরামত করে নিতে হবে (যদি কোন ফুটো বা ছিদ্র থাকে)। ড্রেনেজ ব্যবস্থার দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। একেবারে কাঁচা মেঝে হলে, বর্ষাকালে ইটের ববস্থা করতে হবে। গোবরসহ অন্যান্য বর্জ্য নিয়মিত ও ঘন ঘন পরিস্কার করতে হবে। দুগ্ধবতী গাভীর জন্য ফ্লোর হাইজিন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ম্যাস্টাইস্টিস প্রতিরোধে এটির বিকল্প নেই।
২. ক্ষুরারোগ, বাদলা, তড়কা, গলাফুলা খুবই মারাত্বক সংক্রামক রোগ্। বর্ষাকালে এগুলোর সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশী। সঠিক সময়ে প্রতিষেধক টিকার মাধ্যমে এ রোগগুলোর প্রতিরোধ সম্ভব। সংক্রমণ ঠেকাতে নিম্নোক্ত ভ্যাক্সিনেশন সিডিউল মেনে চলা যেতে পারে অথবা ডাক্তারের বা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে টিকা দিতে হবে।
Name of the Vaccine |
Time of vaccination |
Immunity |
Dose |
Anthrax |
Once in a
year (before monsoon) |
One season |
1 ml, S/c |
FMD |
About 6
months of age, then booster after 4 months |
One season |
6 ml, I/m |
Black
Quarter |
Once in a
year (before monsoon) |
One season |
5 ml, S/c |
HS |
Once in a
year (before monsoon) |
One season |
5 ml, S/c |
৩. গবাদিপশুকে বর্ষার শুরুতেই কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। শুরুতেই বলেছি বর্ষায় কৃমি সংক্রমণ বেশী দেখা যায়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। নিকটস্থ ভেটেরিনারী হাসপাতালে বা প্রাণিসম্পদ অফিসে এ সেবা নিতে পারেন। এটি বিনামূল্যে দেয়া হয়।
৪. বহিঃপরজীবি সংক্রমণ প্রতিরোধে খামার সবর্দা পরিস্কার রাখতে হবে। খাবারের পাত্র, পানির পাত্র, খাবারের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করে রাখতে হবে। নিয়মিত জীবাণুনাশক ছিটিয়ে খামারকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। খামারের আশেপাশে জঙ্গল থাকলে কেটে পরিস্কার করতে হবে। এগুলো মশা মাছির উপদ্রব কমাতে সহায়ক হবে।
৫. দানাদার খাদ্য সরবরাহের আগে পরখ করে নিবেন যে, কোন প্রকার ফাঙ্গাস বা মোল্ড দেখা যায় কিনা। শুকনো স্থানে খাবার সংরক্ষণ করুন। পাশাপাশি ঈদুর, তেলাপোকা যেনো খাবার গুদামে না থাকে সেটি নিশ্চিত করুন কেননা এগুলোর মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। দীর্ঘদিন পরে থাকলে খাবার সরবরাহের পূর্বে রোদে শুকিয়ে নিন।
৬. অপরিণত সবুজ ঘাস খামারে বিপদ ডেকে আনতে পারে। ব্লোট হলে গরু মারা ও যেতে পারে। তাই পরিমিত পরিমাণে সবুজ ঘাস খেতে দিন। চাষ করা ঘাস হলে তুলনামূলকভাবে পরিণত ঘাস সরবরাহ করুন। কেননা বর্ষাকালে ঘাসের গ্রোথ অনেক বেশী থাকে। ঘাসের মাধ্যমেও কৃমি সংক্রমণ ঘটতে পারে। এটি প্রতিরোধে ঘাস কেটে আনার পর কিছুক্ষন বোদে রাখুন। তারপর খেতে দিন।ঘাস সব সময় কেটে ছোট করে দিবেন (চপিং মেশিন থাকলে ভাল না থাকলে হাতে কেটে দিন). এতে করে টোটাল ড্রাই ম্যাটার ইনটেক বাড়বে।
৭. গবাদিপশুকে নর্দমা বা পুকুরের ময়লা পানি না খেতে দেওয়াই ভালো। বিশুদ্ধ পানি ক্ষেতে দিন। প্রতিদিনই পানির পাত্র পরিস্কার করুন। নিজে যে পানি পান করবেন, গবাদিপশুকেও সেই নলক‚পের পানিই পান করতে দিন। ময়লা পানি খেলেও রোগ হতে পারে।
৮. ভাইরাসজনিত যেকোন রোগ প্রাণি থেকে প্রাণি সংস্পশের মাধ্যমে ছড়ায়। এগুলো খুবই সংক্রামক। তাই খামারের কোন প্রাণি অসুস্থ হলে প্রথমেই তাকে আলাদা করে দিন। তার খাবার পাত্র, পানির পাত্র সব আলাদা করে দিন। দর্শনাথী বা বাহিরের লোককে খামারে যত কম ঢুকতে দিবেন, ততই ভালো। কুকুর, বেড়াল খামারে ঢুকতে দিবেন না।
৯. নতুন কোন গবাদিপশু হাট থেকে কিনে আনলে, সেটিকে ১৪-২১ দিন আলাদা করে রাখুন। এসময় তাকে কৃমিনাশক খাওয়াতে পারেন ডাক্তারের পরামর্শে। পাশাপাশি তার প্রসাব- পায়খানা, খাদ্যগ্রহণ, তার বিহেবিয়ার পর্যবেক্ষণ করুন। কোন রোগলক্ষণ প্রকাশ না পেলে, সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হলে তাকে খামারের অন্যান্য গবাদিপশুর সাথে রাখুন।
১০. খামারের প্রবেশদ্বারে সম্ভব হলে ফুটবাথ রাখুন। নিয়মিত ফুটবাথের পানি পরিবর্তন করুন। খামারে যারা কাজ করবে, তাদের জন্য আলাদা পোষাক বা অন্তত পক্ষে একটি করে এপ্রন আর বুট জুতো দিন। যেগুলো শুধু খামারে কাজ করার সময় ব্যবহার করবে। খামারে যারা কাজ করে, তাদের মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। বাহির থেকে এসে খামারে ঢুকার পূর্বে নিজে হাত পা ভালভাবে ধুয়ে নিন। বায়োসিকিউরিটির ব্যাপারে সচেতন হোন। শুধু মুরগীর জন্য নয়, গবাদিপশুর জন্যও বায়োসিকিউরিটি সমান গুরুত্বর্পূণ।
সর্বোপরি যেকোন সমস্যায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তা নিন। সেখানে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, ভেটেরিনারী সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন বিনামূল্যে। আশা করা যায়, এগুলো মেনে চললে, আপনার খামার বর্ষাকালেও নিরাপদ থাকবে। সবাই ভাল থাকুন।
নূরন্নবী সাগর
লেকচারার, বাকৃবি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box