বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। গতবছর শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছিলো। মৃত্যু ও সংক্রমণ হার দুটোই কমে এসেছিলো। তারপরে টিকাও চলে আসলো। সব মিলিয়ে অনেকেই ভাবতে শুরু করলো করোনা হয়তো পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে শীঘ্রই। সবকিছুই স্বাভাবিক হতে লাগলো। গণপরিবহণে ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভীড় বাড়তে লাগলো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন থেকে শুরু করে নিয়মিত কর্মসূচী চালু হলো। দেশের বিভিন্ন যায়গায় ছোট বড় মিলিয়ে বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। রাষ্ট্রীয় দিবস সমূহের অনুষ্ঠান ভার্চূয়াল থেকে বের হয়ে শারিরিক উপস্থিতিতে শুরু হলো। বিভিন্ন বড় বড় অনুষ্ঠান উদযাপন হতে থাকল। বিসিএস পরীক্ষা হয়ে গেলো। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বেশ আড়ম্বরভাবে উদযা্পিত হলো। বই মেলা শুরু হলো। করোনা শুধু সীমাবদ্ধ থাকলো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীর মধ্যে। সেটিও খুলে দেয়ার তারিখ নির্ধারণ হলো। তবে তা আবারো আটকে গেলো এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
সরকার সবকিছু খুলে দিলো এই শর্তে যে, সেখানে সামাজিক দূরত্ব ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি কোথায় যেন হারিয়ে যেতে শুরু করলো্। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে করোনা বলতে আসলে কিছুই নেই। এই বোধটি সাধারণ একজন স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিতদের একটা বড় অংশের মধ্যে দেখা গেলো। মাস্কের ব্যবহার পর্যন্ত কমে গেলো। গত বছর যে মৃত্যুর মিছিল আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলসহ অনেক দেশে শুরু হয়েছিলো, সেরকম পরিস্থিতি আমাদের দেশে হয় নি। মৃত্যুহারও সীমার মধ্যে ছিলো। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সহায়তায় প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অসহায়ত্ব আমরা দেখেছিলাম, চিকিৎসা সামগ্রী থেকে শুরু করে মৃত্যু মানুষের দাফন পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেজে সংকট আমরা দেখেছি। আইসিইউ এর তীব্র সংকটের কারণে ইতালিতে অতিবৃদ্ধদের আইসিইউ থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের বাঁচানার চেষ্টা আমরা দেখেছি। আমাদের দেশে যেহেতেু ওরকম কিছু ঘটেনি, তাই ঘটনাগুলো সেরকমভাবে আমাদের মনে দাগ কাটে নি, কোন ভয়ও জাগাতে পারে নি। আমাদের নিকট মহামারীর বিশ্বাসযোগ্যতাও অর্জন করতে পারে নি। অনেকেরই মনে হয়েছে এটি আসলে মহামারীই নয়।
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন হয়েছে একথা সত্য। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেকগুন। গল্প করবার মতো বেশ কিছু বড় প্রজেক্ট আমরা শেষ করেছি বা করছি। তার মানে এটি কোনভাবেই নয় যে, আমরা আমেরিকার মতো কিংবা প্রথম বিশ্বের কোন দেশের কাতারে পৌছে গেছি। মনে রাখা প্রয়োজন, এই মহামারীর একটা স্টেজে প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ আইসিইউ থেকে শুরু করে ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর একটা বড় সংকটকালীন অবস্থা পার করেছে। চিকিৎসা সেক্টরে আমাদের সক্ষমতা যে কতটা তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে সারাদেশে আইসিইউ এর সংখ্যা হিসেব করলেই যে কারও বোঝার কথা। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বীপরীতে আমাদের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা যে কতটা অপ্রতুল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েকদিনে যে গতিতে সংক্রমণ বাড়ছে এতেই কোথাও রোগী ভর্তির জন্য বেড পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেলে রোগীদের সিরিয়াল নাম্বার দেয়া হচ্ছে বেড ফাকা সাপেক্ষে ভর্তি করা হবে মর্মে । অক্সিজেন এর অভাবে হাসপাতালের ফ্লোরে রোগী কাতরানো অবস্থায় মৃত্যু দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে।
পরিস্থিতি সামনে আরও অবনতি ঘটতে পারে। সারাবিশ্বে আবার করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এই ধীরে ধীরে কমতে থাকা করোনা মহামারীর আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকা নিয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব সেটি আমি বা আমরা কতটুকু পালন করেছি সেটিও বিবেচনা করতে হবে। মানছি সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত বিতর্কিত ছিলো, কিন্তু আমার উদাসীনতা কি কোনভাবেই দায়ী নয়? আমাকে সরকার বার বার বলেছে মাস্ক সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সেটি কতটুকু করতে পেরেছি আমরা। অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিই বা কতটুকু মেনে চলেছি। বিন্দু বিন্দু অবহেলা আজ সিন্ধুতে রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে ( ব্রাজিলে যেটি হয়েছে) যাওয়ার আগে সকলের আবার সম্মিলিত প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে সরকার হয়তো কঠোর লকডাউনে যেতে পারে। সেখানে আমরা দেখেছি নিম্ন আয়ের মানুষদের কি অবর্ণনীয় কষ্ট । সেটিকে রুখতে হলে সবাইকেই নিজেদের জায়গা থেকে সচেতনতা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলছে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, প্রতিদিন দুবেলা গরম পানির ভ্যাপার নেয়া, ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা এ ভাইরাসকে রুখে দিতে পারে। আসুন সবাই মিলে সুরক্ষা বলয় তৈরী করি, এটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সচেতন হই। মনে রাখবেন কোন ভাবেই সংক্রমিত হলে মৃত্যুঝুকি অনেক বেশি কেননা আপনি যত ধনী কিংবা ক্ষমতাশালী হোন না কেন, এই সংকটকালীন মূহুর্তে হাসপাতালে একটি বেড কিংবা আইসিইউ পাবেন কিনা তার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। কেননা নিকট অতীতে অনেক উন্নত দেশও এরকম সংকট মোকাবিলা করেছে বা করছে। পাশাপাশি সরকারকে অনুরোধ করবো, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করুন, দেশের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মূল্যায়ন করুন। এদেশে তো জ্ঞানীদের কদর কোনদিনই হয় নি, অন্তত এই সংকটকালীন মূহূর্তে দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটা জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করুন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।
মোঃ নূরন্নবী ইসলাম সাগর (সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box